বাংলা: মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি

আধুনিক বাংলা কবিতার জনক, বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা, প্রথাবিরোধী ধারার প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈতৃক বাসভূমি কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি। যশোর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি। তিনি বাবা রাজনারায়ণ বসু ও মা জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি এ বাড়িতেই তার জন্ম। কয়েকটি দ্বিতল ও একতলা ভবন আছে এ বাড়িতে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো মস্তবড় পুকুর। পুকুরপাড়ে বিশাল আকৃতির কিছু আমগাছ, যার তলে বসে মন শীতল করে নিতে পারেন। সেখান থেকে পূর্বপাশের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই কবির পারিবারিক দেবালয়, এখনও নিয়মিত দুর্গাপূজা হয়। দেবালয়ের বাঁ পাশে প্রত্যেক কক্ষে সাজানো আছে কবি পরিবারের ব্যবহৃত খাট, আলমারি, চেয়ার-টেবিলসহ আসবাব ও বিভিন্ন সামগ্রী। এর মধ্যে আছে কারুকাজ খচিত কাঠের বাঙ্, কুকুরমাথা গ্রামোফোন, একটি পাথরের পাত্র, টুপি রাখার পাত্র, আলনা, ছোট খাট, টেবিল প্রভৃতি, যা কবি পরিবারের ঐতিহ্য বহন করে। আছে বহু প্রামাণ্য দলিল ও দুষ্প্রাপ্য ছবি। দত্তবাড়ির মধুসূদন একাডেমিতেও প্রদর্শিত হচ্ছে কবির স্মৃতিময় বিভিন্ন নিদর্শন। উত্তরদিকের শেষ মাথায় বেরিয়ে সামনে রয়েছে একটি তুলসী মঞ্চ, সেখানেই কবি জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বদিকের দ্বিতল ভবনটি কবির কাকার বাড়ি। ভেতর বাড়িতে আছে আরেকটি শান বাঁধানো পুকুর। বিভিন্ন গাছগাছালির শ্যামল ঘন ছায়া আসন পেতে আছে ভিটায়। দত্তবাড়ির দক্ষিণপাশে রয়েছে মধু কবির আবক্ষ মূর্তি। এর নিচে লেখা রয়েছে, 'দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ট ক্ষণকাল...।' কবিতার লাইনটি পড়ে হারিয়ে যাবেন কবির জীবন ইতিহাসের কোলে। মনে পড়বে অসাধারণ প্রতিভাধর এ কবির অন্যান্য সৃষ্টির কথা। কবি যে কাঠবাদাম গাছতলায় বসেছিলেন সে গাছটি আজও আছে। আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল, মাইকেল মধুসূদন একাডেমি, মিউজিয়াম ও গ্রন্থাগার। নদীপাড়ে কবির স্মরণে রাখা আছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। বাড়িতে একটি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সাগরদাঁড়ির পথপাশে ১৮ শতকে নির্মিত শেখপুরা তিন গম্বুজ মসজিদ। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে শিশু কবি এ মসজিদে আরবি ও ফারসি ভাষা শিখেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় আসেন। যৌবনে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম গ্রহণ করেন। এ কারণে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করা হয়। তিনি গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষালাভ করেন। মাদ্রাজে ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতা করেন ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ও মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণ ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে তিনি মাতৃভাষায় আকৃষ্ট হয়ে বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করেন। বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে মেঘনাদবধ মহাকাব্য রচনা। তার অন্যান্য গ্রন্থাবলি- দ্য ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী নাটক, পদ্মাবতী নাটক, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো, একেই কি বলে সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, হেকটরবধ উল্লেখযোগ্য। জীবনের শুরুতে দুই হাতে টাকা বিলাতেন। পকেটে হাত দিয়ে মুঠোতে যা উঠে আসত তা দিয়ে দিতেন এবং গর্ব সহকারে বলতেন, রাজ নারায়ণের ছেলে গুনে টাকা দেয় না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, জীবনের ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় কপর্দকশূন্য, রোগযন্ত্রণা ও দারিদ্র্য দুঃখ-কষ্টে ১৮৭৩ সালে কলকাতায় করুণ মৃত্যু হয় এ মহাকবির।